স্ক্রল করতে করতে জীবন শেষ হয়ে যায়!

You are currently viewing স্ক্রল করতে করতে জীবন শেষ হয়ে যায়!

স্ক্রল করতে করতে জীবন শেষ হয়ে যায়!

একটা সময় ছিল যখন “টাইম পাস” বলতে আমরা বারান্দায় বসে আকাশ দেখতাম, বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতাম, বা বইয়ের পাতা ওল্টাতাম। আজকাল “টাইম পাস” মানে ফোন হাতে নিয়ে অফিস-বাস-বিছানা—সব জায়গায় শুধু স্ক্রল। রিল থেকে রিল, পোস্ট থেকে পোস্ট। কখন যে এক মিনিট থেকে এক ঘণ্টা, আর এক ঘণ্টা থেকে পুরো দিন পার হয়ে যায়, আমরা টেরই পাই না। আর এই অজান্তেই আমাদের জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ—সময়—চুপিসারে হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে।

১. গড়ে প্রতিদিন ২ ঘণ্টা ২৪ মিনিট—এটা কি সত্যিই “অল্প”?

বাংলাদেশে একজন গড় স্মার্টফোন ব্যবহারকারী প্রতিদিন সোশ্যাল মিডিয়ায় ২ ঘণ্টা ২৪ মিনিট সময় ব্যয় করেন (DataReportal ২০২৪)। বছর শেষে এই সময় দাঁড়ায় প্রায় ৩৬ দিন! মানে, পুরো একটা মাসের বেশি আমরা শুধু স্ক্রল করি। এই ৩৬ দিনে আমরা একটা নতুন ভাষা শিখতে পারতাম, একটা বই লিখে ফেলতে পারতাম, পরিবারের সঙ্গে অজস্র স্মৃতি গড়তে পারতাম। কিন্তু তার বদলে আমরা দেখি কে কোথায় বেড়াতে গেছে, কে কী খেয়েছে, কার জীবন কতটা “পারফেক্ট”।

২. ডোপামিনের ফাঁদ

সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলো তৈরি করা হয়েছে আমাদের মস্তিষ্কের ডোপামিন লুপকে কাজে লাগিয়ে। প্রতিটি লাইক, কমেন্ট, শেয়ার আমাদের মনে একটা ছোট্ট “পুরস্কার” দেয়। ফলে আমরা আরও বেশি চাই। এটা ঠিক যেন জুয়ার মেশিন—পরের বার হয়তো বড় জ্যাকপট পাব! কিন্তু আসলে আমরা শুধু সময় আর মানসিক শান্তি হারাই। গবেষণায় দেখা গেছে, যারা দিনে ৩০ মিনিটের বেশি সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করেন, তাদের মধ্যে ডিপ্রেশনের ঝুঁকি ২৭% বেশি (Journal of Social and Clinical Psychology, ২০১৮)।

৩. তুলনার বিষে ভরা জীবন

“ওর জীবনটা কত সুন্দর! আমারটা এত খারাপ কেন?”
এই প্রশ্নটা আমরা কম-বেশি সবাই নিজেদের করেছি। কিন্তু আমরা যা দেখি তা কারও জীবনের “হাইলাইট রিল” মাত্র। কেউ কষ্টের ছবি পোস্ট করে না, ব্যর্থতার স্টোরি দেয় না। ফলে আমরা নিজেদের পুরো সিনেমার সঙ্গে অন্যের ট্রেলারের তুলনা করি। এই তুলনা আমাদের আত্মবিশ্বাস কমায়, উদ্বেগ বাড়ায়, এবং একটা অদৃশ্য হীনম্মন্যতায় ভোগায়।

৪. ঘুম চুরি করে নিচ্ছে ব্লু লাইট

রাত ২টা বাজে। বিছানায় শুয়ে শুয়ে “আরেকটা রিল” দেখতে দেখতে হঠাৎ ভোর। পরের দিন অফিসে বা ক্লাসে চোখের নিচে কালি। ব্লু লাইট আমাদের মেলাটোনিন হরমোনের ক্ষরণ কমিয়ে দেয়, ফলে ঘুম আসে না। WHO-র মতে, কিশোর-তরুণদের মধ্যে ঘুমের সমস্যা বেড়ে যাওয়ার একটা বড় কারণ সোশ্যাল মিডিয়া।

৫. সম্পর্কগুলো হচ্ছে “ভার্চুয়াল”

আগে বন্ধুর সঙ্গে দেখা হলে চোখে চোখে কথা হতো, হাসি-কান্না শেয়ার হতো। এখন বন্ধুর জন্মদিনেও আমরা শুধু একটা স্টিকার দিয়ে দায় সেরে নিই। বাবা-মা বসে আছেন পাশের ঘরে, আর আমরা হাজার মাইল দূরের অচেনা মানুষের সঙ্গে চ্যাট করি। এভাবে আমরা কানেক্টেড হচ্ছি ঠিকই, কিন্তু আসলে আরও একা হয়ে যাচ্ছি।

তাহলে উপায় কী?

সমাধান হলো সোশ্যাল মিডিয়াকে “ব্যবহার” করা, “ব্যবহৃত” না হওয়া। কিছু ছোট পদক্ষেপই জীবন বদলে দিতে পারে:

  • দিনে নির্দিষ্ট সময় ঠিক করুন (যেমন: ৩০-৪৫ মিনিট)
  • ফোনকে গ্রেস্কেল মোডে রাখুন (রং কম দেখলে আকর্ষণ কমে)
  • রাত ১০টার পর ফোন অন্য ঘরে রাখুন
  • “স্ক্রিন টাইম” চেক করুন প্রতি সপ্তাহে, নিজেকে বিচার করুন
  • যে অ্যাকাউন্টগুলো আপনাকে নেগেটিভ ফিল করায়, আনফলো করুন নির্দ্বিধায়

সোশ্যাল মিডিয়া কোনো শত্রু নয়। এটা একটা টুল। কিন্তু ছুরি যেমন রান্নার কাজে লাগে আবার খুন করতেও লাগে—সোশ্যাল মিডিয়াও তেমনি। নিয়ন্ত্রণ যার হাতে, জীবন তার হাতেই থাকে।

আজ থেকে ফোনটা একটু নামিয়ে রাখুন। চারপাশে তাকান। যে মানুষগুলো আপনার পাশে আছে, তাদের চোখে চোখ রাখুন। জীবনটা আসলে এই মুহূর্তগুলোতেই লুকিয়ে আছে—কোনো রিলে নয়।

স্ক্রল করতে করতে যেন জীবন শেষ না হয়ে যায়।
জেগে উঠুন, আগে বাঁচুন।

Leave a Reply